মাস্টার ট্যাকটিশিয়ানদের খুঁটিনাটি: যাদের দারুণ উদ্ভাবনী কৌশল আধুনিক ফুটবলকে এক অনন্যমাত্রায় নিয়ে গিয়েছে

Image
ফুটবল এমন একটি খেলা যেখানে শারীরিক দক্ষতার পাশাপাশি কৌশলগত পরিশীলনও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ফলশ্রুতিতে পৃথিবীর প্রায় অধিকাংশ মানুষের কাছে জনপ্রিয় এই খেলায় বছরের পর বছর ধরে উল্লেখযোগ্য বিবর্তন হয়েছে। এই বিবর্তনটি আসলে কৌশলগত চিন্তাভাবনা এবং উদ্ভাবনের ক্রমাগত পরিবর্তনের জন্য প্রাথমিকভাবে দায়ী। এই বিষয়ে, আমরা কিছু আইকনিক ফুটবল মাস্টার ট্যাকটিশিয়ানদের কৌশল কাটাছেঁড়া করলেই বুঝতে পারি যে তাদের দারুণ উদ্ভাবনী কৌশলগুলো আধুনিক ফুটবলকে উল্লেখযোগ্যভাবে অনন্য এক মাত্রা দিয়েছে। তো সমগ্র ফুটবল সমর্থকদের সাথে নিয়েই তাদের ফুটবল দর্শন এবং আকর্ষনীয় বিবর্তন একটু আলোকপাত করে দেখা যাক- রাইনাস মিশেল এবং টোটাল ফুটবলের আগমন- নেদারল্যান্ডস থেকে উঠে আসা রাইনাস মিশেল 'টোটাল ফুটবল' প্রবর্তনের মাধ্যমে ফুটবল কৌশলে আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন। এই সিস্টেমে সাধারণত খেলোয়াড়েরা ফ্লুইডলি তাদের পজিশন স্যুইচ করে থাকে, যার ফলে বল দখলে থাকাকালীন মাঠের জায়গাগুলো কিছুটা প্রসারিত হয় এবং ডিফেন্স করার সময় জায়গাগুলো আবার সংকুচিত হয়ে যায়।এটি স্পষ্ট যে মিশেলের ফ্লেক্সিবল এবং পজিশনলেস খেলার দর্শন ফুটবলে বিপ্লব ঘটিয়েছিল যা ...

পাউ কুবার্সি- দ্য রোলস রয়েস কাতালান

 


লেখাটি শুরু করার আগে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর খুব করে জানার ছিল- বার্সেলোনা তাদের ইয়ুথ একাডেমির বাচ্চাদের প্রতিদিন কি ধরনের খাবার দিয়ে থাকেন ?! জাভির অধীনে গত মৌসুমে বার্সেলোনা স্প্যানিশ সুপার কাপ এবং লা-লীগা জিতলেও এই মৌসুমে তার দল সামগ্রিক উঠানামার ভিতর দিয়েই যাচ্ছে। তবে এই জাভির অধীনেই লা মাসিয়া থেকে লামিন ইয়ামাল, আলেহান্দ্রো বালদে, মার্ক গুইয়ু এবং বেশকিছু বিশ্বমানের সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়দের মূলদলে অভিষেকের সুযোগ হয়েছে। সম্প্রতি এই তালিকায় যোগ দিলেন মাত্রই ১৭ বছর বয়সে পা রাখা স্প্যানিশ সেন্টারব্যাক পাউ কুবার্সি!

কুবার্সিকে ঘিরে সমর্থকদের মাঝে উত্তেজনা বেশ লক্ষনীয়। এটি কেবলমাত্র বার্সেলোনার অনিশ্চিত আর্থিক পরিস্থিতি তাদের খুব বেশি স্প্ল্যাং করা থেকে বিরত রাখবে বলে নয়, বরং এই সম্ভাবনাময় সেন্টারব্যাকের মাঝে একটি দলের ব্যাকলাইনকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য যেসব গুণাবলি থাকা দরকার তার সবকিছুই তিনি বেশ ভালোভাবে আয়ত্ত করেছেন বলেই হয়ত তাকে নিয়ে বেশ কথা হচ্ছে।

তাহলে, পাউ কুবার্সি আসলে কে, এবং তাকে ঘিরে উত্তেজনা কি যুক্তিযুক্ত? এক নজরে দেখে নেওয়া যাক-

কে এই পাউ কুবার্সি?

নিঃসন্দেহে এফসি বার্সেলোনা সমর্থকরা জানলে খুশি হবেন যে পাউ কুবার্সি জন্মসূত্রে একজন কাতালুনিয়ান, বেশ ছোটবেলা থেকেই কাতালুনিয়ান এই ক্লাবটার প্রতি তার ভালোবাসা জন্মায়। তিনি জিরোনা যুব একাডেমির মাধ্যমে লা মাসিয়াতে যোগ দিয়েছিলেন, সিটি গ্রুপের মালিকানাধীন এই ক্লাব এইবার লিগে অসাধারণ পারফরম্যান্সের দরুন স্বপ্নের মতো এক মৌসুম কাটাচ্ছে।

তিনি ১১ বছর বয়সে অর্থাৎ ২০১৮ সালে বার্সেলোনায় যোগ দিয়েছিলেন এবং তিনি এত দ্রুত তার প্রতিভার সুবিচার করা শুরু করেন যে এর ঠিক ৩-৪ থেকে বছর পর অর্থাৎ ২০২২ সালে ভিক্টোরিয়া প্লাজেনের বিপক্ষে অভিষেক হওয়ার মাধ্যমে উয়েফা যুব লীগে বার্সেলোনার হয়ে খেলা তৃতীয় সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় বনে যান। কেবল লামিন ইয়ামাল এবং ইলিয়াক্স মোরিবা তার চেয়ে কম বয়সে উয়েফা যুব লীগে অভিষেক করেন।

প্রতিনিয়ত নিজেকে একধাপ এগিয়ে নেওয়ার কারণে যুবদলের কোচদের পক্ষে তাকে উপেক্ষা করা ছিল প্রায় অসম্ভব। পরবর্তী ছয় মাসে তিনি নিজেকে এক অনন্য মাত্রায় নিয়ে যান। ২০২৩ সালের এপ্রিলে মূলদলের সঙ্গে অনুশীলন করছিলেন তিনি, জুলাইয়ে পেশাদার চুক্তি স্বাক্ষর করেন বার্সেলোনার সাথে এবং সম্প্রতি লীগে রিয়াল বেতিসের বিপক্ষে ৪-২ গোলের জয়ের ম্যাচে বার্সেলোনার জার্সিতে লীগে অভিষেক হয় তার।

বার্সেলোনার হয়ে তার অভিষেক হয় মূলত কোপা দেল রেতে ইউনিয়নিস্তাসের বিপক্ষে ম্যাচে। যেখানে তিনি মাত্র ৪৫ মিনিট খেলার সুযোগ পান এবং একটি গোলে সহায়তা করেন। সম্প্রতি ১৭ বছর বয়সে পা রাখা কুবার্সির জন্য প্রথম দলে নিজেকে প্রমাণ করার জন্য মঞ্চ অনেকটা প্রস্তুত এবং নিজেকে গাভি, পেদ্রি এবং ইয়ামালের মতো বিশ্বমানের প্রতিভা হিসাবে প্রমাণ করার এটাই সঠিক সময় বলে অন্তত আমার কাছে মনে হয়।

পাউ কুবার্সির সম্ভাবনা:

লা মাসিয়া তাদের ওয়ান্ডারকিডদের সাথে পুরো বিশ্বফুটবলে যে মেলবন্ধন তৈরি করেছে তা এটিকে বিশ্বের অন্যতম সেরা একাডেমিতে পরিণত করে।

কুবার্সির ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। যদি বার্সেলোনা তার প্রতিভার সঠিক কদর করতে পারে তবে তিনি লা মাসিয়ার সবচেয়ে বড় সম্ভাবনাময় ডিফেন্ডার হতে পারেন। অতীতে রোনাল্ড আরাউহো, কার্লেস পুয়োল এবং জেরার্ড পিকের মতো ডিফেন্ডাররা লা মাসিয়া থেকে উঠে এসেছে, যারা পরবর্তীতে অতিমানবীয় পারফরম্যান্সের দরুন বার্সেলোনাকে অনেকম্যাচে এবং শিরোপা জয়ের সুভাষ দিয়েছেন।

এফসি বার্সেলোনা কোচ জাভি কুবার্সিকে হাইলি প্রেইস করেন। মূলদলে একজন তরুণ আক্রমণভাগের খেলোয়াড়কে অভিষেক করানোটা সহজ কারণ প্রতিপক্ষের অর্ধে ভুলের জন্য তাকে সরাসরি খেসারত দিতে হয় না। বরং ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডের পাশাপাশি সেন্টার-ব্যাক হচ্ছে এমন পজিশন যেখানে তরুণ খেলোয়াড় অভিষেক করানোটা সবচেয়ে কঠিন।

একাগ্রতার অভাব, ক্ষণিকের ত্রুটি, পজিশনিংয়ে এক ইঞ্চি ভুল এবং শীর্ষ স্তরের ফরোয়ার্ডরা তরুণ ডিফেন্ডারদের বেশ ভালোভাবেই ভুগিয়ে থাকে। তাই রিয়াল বেতিসের বিপক্ষে কুবার্সিকে প্রথম একাদশে রাখা এবং দলের দারুণ আক্রমণভাগই বলে দিচ্ছে জাভির খেলোয়াড়দের ওপর আসলে কতটা ভরসা করেন।

কুবার্সি তার সেরা সময়ে, প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে একজন আধুনিক সেন্টার-ব্যাক হতে পারে যা এমন কারও কাছ থেকে আশা করা যায় যিনি লা মাসিয়ার শিক্ষা খুব ভালোভাবেই নিজে থেকে আয়ত্ত করেছেন। আসুন আমরা এখন তার খেলার স্টাইল ডিকোড করার চেষ্টা করি।

দক্ষতা এবং খেলার শৈলী:

লা মাসিয়া থেকে আসা একজন তরুণ খেলোয়াড়ের কাছ থেকে প্রথম যে জিনিসটা আপনি আশা করবেন তা হলো বল পায়ে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ হতে হবে এবং পজিশন অনুযায়ী প্রচুর পরিমাণে প্রযুক্তিগত দক্ষতা থাকতে হবে।

সত্যকথা বলতে কুবার্সির মধ্যে এই গুণাবলি বেশ ভালোভাবেই লক্ষনীয়। যে দলগুলো এভাবে খেলতে চায় তাদের জন্য সে একজন আদর্শ বল প্লেয়িং সেন্টার-ব্যাক।

পাউ কুবার্সির খেলার স্টাইল দেখে সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি চোখে পড়ে তা হ'ল তিনি কীভাবে সর্বদা বলটি সামনের দিকে খেলতে থাকেন। নিসন্দেহে অনুমান করে বলা যায় যে মাঠের ফাঁকা বড় জায়গাগুলোতে থ্রেট ক্রিয়েটের সময় তার প্রগতিশীল পাসগুলো বেশ কার্যকর হবে দলের জন্য।

মাত্র দেড় ম্যাচেই ফ্রেঙ্কি ডি ইংয়ের সঙ্গে তাঁর রসায়ন স্পষ্ট। এই ডাচম্যান সেন্টার-ব্যাকদের মাঝখানে ড্রপ করে বল নিয়ে এগিয়ে যান। যাইহোক, কুবার্সি মাঝখানে অবস্থান করে এবং ডি ইয়ংকে অপনেন্ট প্রেসের বিপক্ষে একটি লাইনকে বাইপাস করার স্বাধীনতা দেয়। এছাড়া ম্যাচের বাকিটা সময় কুবার্সি ভালো খেলার কারণে ফ্রঙ্কিকে খুব একটা পরীক্ষার সামনে পরতে হয়নি।

কুবার্সির আরেকটি দক্ষতা হলো তিনি বেশ ভালো প্রেস-প্রতিরোধী। প্রকৃতপক্ষে, যখন তার কাছে বল থাকে তখন তিনি প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের তার দিকে প্রেস করতে আমন্ত্রণ জানান। শোল্ডার ড্রপ করে তিনি অপনেন্টের প্রেস বিট করেন এবং প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রা তাকে আটকানোর  চেষ্টা করেন। আরেকটু সহজ ভাষায় বললে বলপায়ে নিজেকে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ মনে করাটা সর্বাধিক অভিজাত খেলোয়াড়দের মধ্যে একটি গুণ এবং কুবার্সি এটি মাত্র ১৭ বছর বয়সে বেশ ভালোভাবেই আয়ত্ত করেছে।

তবে তাকে এখনে অনেক বিষয় নিয়ে কাজ করতে হবে, বিশেষ করে প্রথাগত রক্ষণাত্মক অর্ধে। উদাহরণস্বরূপ, তাকে কখনও কখনও বল রিকোভারির ক্ষেত্রে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। তাকে মাঝেমাঝে অপ্রয়োজনীয় ফাউল করতে হবে এবং প্রতিপক্ষের ফরোয়ার্ডদের থেকে বুদ্ধিমত্তার দরুন ফাউল আদায় করে নিতে হবে। তবে, তার বয়স বিবেচনায়, তিনি একজন খেলোয়াড়ের চেয়ে অনেক বেশি পালিশড ডিফেন্ডার।

বার্সেলোনায় পাউ কুবার্সি:

আশ্চর্যজনকভাবে, কুবার্সিকে আক্ষরিক অর্থে অনেক কিছু করতে হবে। তবে জাভির অধীনে তিনি আশা করতে পারেন অন্যতম সেরা ম্যানেজারের থেকে বেশ ভালো দীক্ষা পাবেন তিনি।

লা মাসিয়া থেকে এই সোনালি প্রজন্মের উত্থান দক্ষতার সঙ্গে সামলেছেন বার্সেলোনার সাবেক এই মিডফিল্ডার। প্রকৃতপক্ষে, তিনি কখনও কখনও তরুনদের উপর খুব বেশি নির্ভর করার জন্য দোষী হতে পারেন, যেমনটি পেদ্রি এবং গাভির সাম্প্রতিক ইনজুরি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে।

কুবার্সির জন্য যেটা কাজ করবে তা হলো, মিডফিল্ডের বিপরীতে জাভির রক্ষণভাগে অনেক বিকল্প আছে। আরাউহো, কুন্দে, বালদে, রবার্তো, ক্রিসটেনসেনের মতো খেলোয়াড়রা থাকার কারণে জাভির পক্ষে অবিলম্বে কুবার্সিকে প্রথম দলের অপরিহার্য অংশ করার কোনও তাগিদ নেই।

আমি মনে করি তিনি কুবার্সিকে ধীরে ধীরে সুযোগ দিয়ে তৈরি করতে পারেন এবং রোনাল্ড আরাউহোর মতো আরেক লা মাসিয়ান স্নাতকের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত যাতে কিছু না কিছু শিখতে পারেন।

তবে কুবার্সি যদি তার উল্কাপিণ্ডের মতো উত্থান অব্যাহত রাখেন তবে জাভির কাছে অতি শীঘ্রই তিনি পছন্দের পাত্রে পরিণত হবেন এবং জাভিও তাকে সরাসরি প্রথম দলে রাখতে বাধ্য হবেন।

আমার মনে হয় আপাতত বার্সেলোনা অ্যাথলেটিকের (বি দল) হয়ে না খেলে প্রথম দলের স্কোয়াডে থাকা উচিত তার।এমনকি স্কোয়াডে থাকার দরুন প্রথম দলের সাথে প্রশিক্ষণ বি দলের হয়ে খেলার চেয়ে আরও ফলপ্রসূ অভিজ্ঞতা বয়ে আনবে কুবার্সির জন্য। ১৭ বছর বয়সী এই তরুণ ডিফেন্ডারের জন্য সেটা হবে এক অনন্য কীর্তি, তবে আপনি এই মুহুর্তে লা মাসিয়ার কাছ থেকে এটিই আশা করেন! আশা করব তিনি বার্সেলোনাকে একটা লম্বা সময় ধরে সার্ভিস দিবেন। তার ভবিষ্যতের জন্য শুভকামনা রইল।


Tonmoy Shome





Comments

Popular posts from this blog

লিওনেল মেসি- দ্য ম্যাজিকম্যান

থিয়াগো আলমাদা- দ্য নিউ মিডফিল্ড জেম অফ আর্জেন্টিনা

মাস্টার ট্যাকটিশিয়ানদের খুঁটিনাটি: যাদের দারুণ উদ্ভাবনী কৌশল আধুনিক ফুটবলকে এক অনন্যমাত্রায় নিয়ে গিয়েছে